sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

বিশ্ববাসিকে ভারতবর্ষের অবদান "আয়ুর্বেদ- বা বৈদ্যক"


(অনেক অজানা কথা- ইবনে সিনার বই আয়ুর্বেদের আরবি অনুবাদ নিজের লেখা নয়)
আয়ুর্বেদ ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে আয়ুর্বেদ চারটি বেদের সার এবং কশ্যপ মুনির মতে পঞ্চম বেদ। অন্য মতে অথর্ববেদের একটি উপাঙ্গ আয়ুর্বেদ। দেহ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে নানা কিছু জিনিস বেদগুলির মধ্যে ছড়ান আছে। ঋক্‌বেদে বায়ু, পিত্ত কফ এবং অথর্ববেদে নর কঙ্কালের বিভিন্ন অংশের উল্লেখ আছে। বৈদ্যক অর্থে ক্লীবলিঙ্গে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ।
কাহিনী আছে এই বিশেষ বেদটি প্রজাপতি রচনা করে সূর্যকে দেন। সূর্য আর এক সংহিতা তৈরি করে ধন্বন্তরি, অশ্বিনীকুমারদ্বয় ইত্যাদি ষোল জনকে পাঠ করান। এরা প্রত্যেকে আবার এক একখানি চিকিৎসা শাস্ত্র রচনা করেন। অন্য মতে ব্রহ্মা তার ধ্যানলব্ধ জ্ঞান প্রজাপতিকে দেন এবং প্রজাপতি অম্বিনীকুমারদের দেন। ইন্দ্র এঁদের একজনের কাছ থেকে এই বিদ্যা আয়ত্ত করে ভরদ্বাজ ইত্যাদি ঋষিকে দেন। ভরদ্বাজ দেন আত্রেয়কে এবং আত্রেয় অগ্নিবেশ ও অন্য শিষ্যদের দেন। অগ্নিবেশের কাছ থেকে পান চরক। আবার ধন্বন্তরি (দিবোদাস) সুশ্রুত ও সহ অধ্যায়ীরা আয়ুর্বেদ আয়ত্ত্ব করেন পরে নাগার্জুন এই শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। প্রথম দিকে এই শিক্ষা মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল। আত্রেয় শিষ্য অগ্নিবেশ প্রথমে সংহিতা রূপে লিপিবদ্ধ করেন। অগ্নিবেশের দেখাদেখি আত্রেয়ের অন্য শিষ্যরাও যেমন ভেল, জতূকর্ণ, পরাশর, হারীত, ক্ষারপাণি ও এক এক সংহিতা লেখেন। পরবর্তী কালে চরক অগ্নিবেশসংহিতাকে বিশেষভাবে সংকলন করেন এবং নাম হয় চরক সংহিতা। এ ছাড়া খরনাদ, বিশ্বামিত্র, অত্রি, মাধব সংহিতা ইত্যাদি নানা গ্রন্থ প্রচলিত ছিল। শল্য চিকিৎসক সুশ্রুত প্রণীত গ্রন্থের নাম সুশ্রুতসংহিতা। আয়ুর্বেদের মধ্যে তান্ত্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি নামে আর একটি শাখা আছে। অনেকের মতে এটি আর্যপূর্ব যুগের চিকিৎসা পদ্ধতি। বৈদিক পদ্ধতিতে দুটি ধারা আছে একটি আত্রেয় এবং একটি ধন্বন্তরি। তান্ত্রিক পদ্ধতিতেও দুটি ধারা রসসাধক ও বিষসাধক। রসসাধকরা পারদশোধন, মারণ প্রভৃতি দিয়ে জরা ও ব্যাধি নিয়ন্ত্রিত করতেন এবং বিষসাধকরা নানা বিষ দিয়ে রোগ ও রোগের যন্ত্রণা উপশম করতেন। বিষ সাধকদের গ্রন্থগুলিই তন্ত্র নামে পরিচিত। রসার্ণব তন্ত্র, রসেন্দ্রসার সংগ্রহ, রসেন্দ্র চিন্তামণি, রসহৃদয় তন্ত্র, রসরত্ন, ঔপধেনব তন্ত্র, ঔরভ্র তন্ত্র, নিমিতন্ত্র, শৌনকতন্ত্র, বিদেহ তন্ত্র ইত্যাদি আরো বহু তন্ত্র রয়েছে।
অনেকের মতে কনিষ্কের সভাতে চরক রাজবৈদ্য ছিলেন। সুতরাং গ্যালেনের (আনু ১৩০-২০০ খৃ) সমসাময়িক হয়তো। কয়েক শতাব্দী পরে ধন্বন্তরিও ও অমর সিংহ। ধন্বন্তরির একটি ভেষজ বিদ্যা ও অমরসিংহের অমরকোষে বহু ভেষজের বিকল্প নাম পাওয়া যায়। শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনী এবং ইন্দ্রের দেহে মেঘের মুষ্ক-সংযোগ ইত্যাদি অবশ্য নিছক কল্পনা। মুসলমান আক্রমণের পর ভারতের বাইরে আয়ুর্বেদ জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে। বাগদাদে খলিফা হারুন অল রসিদ (৭৬৩-৮০৯খৃঃ) আয়ুর্বেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং চরক সুশ্রুত ইত্যাদি আরবিতে অনুবাদ করান। তাঁর সভায় মঙ্খ নামে একজন ভারতীয় চিকিৎসক ছিলেন এবং আয়ুর্বেদের বিষক্রিয়া সম্বন্ধীয় অংশগুলির ফারসি অনুবাদ করেন। চরক সংহিতা অনুবাদ করেন আলি ইবন জৈন এবং অনুদিত সুশ্রত সংহিতার নাম হয় 'কিলল সশুর অল হিন্দি'। বাগভট্টের অষ্টাঙ্গহৃদয় ও মাধবকরের নিদান ও আরবিতে ঐ সময়ে অনুদিত হয়। অষ্টম বা নবম শতাব্দীতে নাগার্জুন চোলাই করা, সত্ত্বপাতন, উৰ্দ্ধপাতন প্রভৃতি পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। বহু বিদ্যার্থীকে চিকিৎসা ও ভেষজ বিদ্যা শেখাবার জন্য হারুন অল রসিদ ভারতে পাঠিয়ে ছিলেন এবং বহু ভারতীয় চিৎিসককে নিয়ে গিয়ে বাগদাদে ও অন্যান্য হাসপাতালে নিযুক্ত করেছিলেন এবং বহু গ্রন্থ অনুবাদ করিয়েছিলেন। অর্থাৎ ইউনানী শাস্ত্রের ওপর আয়ুর্বেদের প্রভাব অনস্বীকার্য।
ব্রহ্মসংহিতা মতে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদে নয়টি বিভাগঃ- কায়চিকিৎসা, শল্য চিকিৎসা, শালাক্যচিকিৎসা, ভূতবিদ্যা, কৌমারভৃত্য, অগদচিকিৎসা, রসায়ন চিকিৎসা, বাজীকরণ চিকিৎসা, পশু চিকিৎসা। পশুচিকিৎসা বাদ দিয়ে বাকি আটটি শাখা মিলে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ।
কায়চিকিৎসাঃ- দেহের যে কোন স্থানের রোগের চিকিৎসা। দুভাগে বিভক্তঃ- শারীরিক ও মানসিক। বায়ু, পিত্ত, কফ এই তিনটি একক ভাবে বা মিলিত ভাবে কুপিত হয়ে যে রোগ ঘটায় তাকে স্বাভাবিক রোগ বলা হয়। বায়ু পিত্ত কফের সুষম অবস্থার নাম সমাগ্নি। এই তিনের স্বাভাবিক অবস্থার ব্যতিক্রম ঘটলে বিষমাগ্নি, তীক্ষাগ্নি বা মন্দাগ্নি অবস্থা দেখা দিতে পারে। বিষমাগ্নি থেকে বাতজ রোগ, তীক্ষাগ্নি থেকে পিত্ত রোগ ও মন্দাগ্নি থেকে কফজ রোগ দেখা দেয়। স্বাভাবিক রোগ ছাড়া আরো দুটি শ্রেণী রয়েছে। একটি সংক্রামক রোগ; যেমন হাম, বসন্ত, চর্মরোগ, অভিষ্যন্দ প্রভৃতি। আর একটি 'আগন্তুক রোগ অর্থাৎ পুড়ে যাওয়া ইত্যাদি দুর্ঘটনা জনিত আসা রোগ। শরীরগত বায়ুকে আয়ুর্বেদ পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছে; প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান ও উদান। বায়ু- প্রকৃতির লোকের দেহে ক্ষিতি ও অপ-এর প্রভাব কম থাকে। পুষ্টির অভাবে দেহের ত্বক ও কেশ শুকিয়ে যায়; অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষীণ ও লঘু হয়ে পড়ে; দেহ ও মনে দৃঢ়তা থাকে না। স্নায়ুতন্ত্র উত্তেজনা প্রবণ হয়ে ওঠে। এবং একটুতেই এদের বাতজর ব্যাধি দেখা দেয়। শারীরিক ও মানসিক ক্ষুধা জনিত দুটি শক্তিশালী প্রবৃত্তির বিরোধই শুচিবায়ু, মূর্ছা, উন্মত্ততা ইত্যাদি বায়ু রোগের কারণ। আয়ুর্বেদে ৮০ প্রকার বায়ু রোগের নিদান সহ বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। চরকের মতে বস্তি, মলাশয়, কোমর, পদযুগল ও পায়ের হাড়গুলি ও প্রধানত পাকস্থলী বায়ুর অধিষ্ঠান। পিত্ত দেহের তাপ ও পরিপাক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। পিত্ত-প্রকৃতির লোকেদের দেহের গঠন হয় মাঝারি। প্রচুর ক্ষুধা ও তৃষ্ণা থাকে। দেহ থেকে প্রচুর ঘাম, মল ও প্রস্রাব নির্গত হয়। গায়ের চামড়া উজ্জ্বল ও মসৃণ থাকে কিন্তু সহজে কুঞ্চিত হয়ে পড়ে। গ্রীষ্মে সহজে কাবু হয়ে পড়ে। দুর্ধর্ষ সাহস থাকলেও কষ্ট সহ্য করতে পারে না। অতি তাড়াতাড়ি জরা ও বাৰ্ধক্য এসে দেখা দেয়। পিত্তের উষ্মাই অগ্নি বা অন্য মতে পিত্ত নিজেই অগ্নি। এই পিত্ত উষ্মা বিরূপ হলে তীক্ষ্মাগ্নি দেখা দেয় এবং পরিণামে অজীর্ণ, গ্রহণী, জ্বর, চক্ষু রোগ ইত্যাদি হতে পারে। স্বেদ, রস, লসিকা, রক্ত ও প্রধানত আমাশয়ে পিত্তের স্থান। কফ দেহের স্নিন্ধতা, জলীয় ভাগ ও পিচ্ছল গতি নিয়ন্ত্রণ করে। মাথা, গ্রীবা, অস্থিসন্ধি, মেদ এবং প্রধানত বুকে কফের স্থান। কফের প্রকোপে সর্দ্দি কাশি প্রভৃতি শ্বসন যন্ত্রের রোগ দেখা দেয়। কফ-প্রকৃতির লোকেদের দেহ সুগঠিত ও কান্তি লালিত্যপূর্ণ। কেশ ঘন ও কালো। আহার ও চলাফেরা মন্থর ও সংযত। ক্ষুধা তৃষ্ণা ঘম বা গ্রীষ্মে এদের বিশেষ কষ্ট হয় না। প্রজনন ক্ষমতা এদের বেশি।
শলাচিকিৎসাঃ- সুশ্রুতে শল্য চিকিৎসার অদ্ভুত উৎকর্ষতা দেখা যায়। হিপোক্রেটিস-এর (৪৬০ খৃ-পূর্ব) বহু আগে ভারতে শল্য চিকিৎসা বিশেষ উন্নতি করেছিল। সুশ্রুত সংহিতায় শতাধিক অস্ত্র এবং চোদ্দ রকম পট্টবন্ধনীর বিবরণ আছে। হাড় ভাঙ্গলে এবং সন্ধিতে হাড় সরে গেলে বিশেষ চিকিৎসার উল্লেখ আছে। ভাঙ্গা হাড় ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে কাঠ বা বাঁশের ফলক দিয়ে বাঁধার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। অস্ত্রে কাটা নানা প্রকার ক্ষতের বিবরণ এই বইতে পাওয়া যায়। কনুইয়ের সামনের দিক থেকে রক্ত মোক্ষণ, জোঁকের ব্যবহার, পেট ও জলমুষ্ক থেকে জল বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা, উপযুক্ত চাপ দিয়ে বেধে রক্তমোক্ষণ বন্ধ করা ইত্যাদি শল্যচিকিৎসার অন্তর্গত। দুর্ঘটনায় আহত হাত পা বা আরোগ্যের সম্ভাবনা হীন রুগ্ন হাত-পা কেটে বাদ দিয়ে কাটা অংশে ফুটন্ত তেলের প্রলেপ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হত। অবৃদ ও বর্ধিত লসিকাগ্রন্থি কেটে বাদ দিয়ে সেখানে সেঁকো বিষ দিয়ে আবার যাতে না হয় ব্যবস্থা ছিল। গাল থেকে মাংস কেটে নিয়ে কাণের সংস্কার করতেও চিকিৎসকরা পটু ছিলেন। নাভির একটু নীচে বাদিকে চিরে নিয়ে পেটের ভেতরে অস্ত্রপ্রচার করা হত। অন্ত্রের কোনখানে টুকরো করে আবার সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হত। দেহের যে কোন নলীয় বা খলীয় অংশে কিছু ঢুকলে তা বার করে দিতে পারতেন। প্রসবের সময় প্রয়োজন হলে অস্ত্রোপচার ও চোখের ছানি কাটাও হত। ভোজ প্রবন্ধে আছে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের আগে রোগকে ভেষজ যোগে সংজ্ঞাহীন করে নেওয়া হত।
শালাক্য চিকিৎসাঃ- অক্ষকের ওপর যে কোন অংশের শল্য চিকিৎসা। অর্থাৎ চোখ, কাণ, নাক ও গলার ভেতর প্রভৃতি অংশে শল্যায়ন। বিভিন্ন তন্ত্র এইরূপ চিকিৎসার বিশেষ বিবরণ আছে।
ভূতবিদ্যাঃ- মানসিক রোগের চিকিৎসা। চরকে অষ্টম অধ্যায়, সুশ্রুতে ষষ্ঠ অধ্যায়ে এবং অষ্টাঙ্গি হৃদয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে বিশেষ ভাবে আলোচিত হয়েছে।
কৌমারভৃত্যঃ- সুশ্রুতে উত্তর তন্ত্রে বারটি পরিচ্ছেদে, কাশ্যপ-সংহিতা ও বৃদ্ধজীবক তন্ত্রে শিশুরোগের বিষয় বর্ণিত হয়েছে। সদ্যোজাত শ্বসনহীন শিশুকে কৃত্রিম শ্বসনের দ্বারা বাঁচিয়ে তোলার বিবরণও আয়ুর্বেদে আছে।
অগদ সংহিতাঃ- নানা বিষের ক্রিয়া জনিত রােগ ও উপযুক্ত চিকিৎসা শাখা। রােগের লক্ষণ, মৃত্যুর পরবর্তী পর্যবেক্ষণ বিবরণও অগদ সংহিতার অংশ।
রসায়ন চিকিৎসাঃ- বৈদিক যুগ থেকেই রসায়ন সাহায্যে চিকিৎসা চলে আসছে। পারদ, লোহা প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট ভেষজ দুহাজার বছর আগেও ভারতে ব্যবহৃত হত। পতঞ্জলি লৌহশাস্ত্র সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। খৃষ্টীয় ৮-৯ শতকে নাগার্জুন গন্ধক ও পারল মিশ্রণে কাজলের প্রবর্তন করেন। চোলাই ইত্যাদি এবং ভেষজের বড়ি তৈরি করে ব্যবহারও নাগার্জুন জানতেন। ভেষজ রূপে সেঁকো বিষের ব্যবহার নাগার্জুনের আগেও ভারতে জানা ছিল। ভেষজগুলি বিভিন্ন অনুপান যােগে ব্যবহৃত হয়।
বাজীকরণ চিকিৎসাঃ- বীর্যধারণ ক্ষমতা, প্রজনন শক্তি বৃদ্ধি প্রভৃতির জন্য আয়ুর্বেদের একটি শাখা। এ বিষয়ে বহু তন্ত্র রয়েছে।
এই আটটি বিষয় ছাড়াও পশু চিকিৎসার দিকও আয়ুর্বেদে অবহেলিত হয় নি। এই শাখার অনেক বই আছে; তার মধ্যে পালকাপ্য সংহিতাতে তীর, গােতম সংহিতাতে গরুর, এবং শালিহােত্র সংহিতাতে ঘােড়ার রােগের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এবং এ ছাড়াও বৃক্ষায়ুবেদে বৃক্ষাদির চিকিৎসা পদ্ধতির কথা আছে।
তথ্যসূত্র- পৌরাণিকা
সংকলনে- #শ্রী কৃষ্ণকমল মিন্টু 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.