sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

আর্যপ্রভা-সৃষ্টিতত্ত্ব-তন্ত্র

এই বার তন্ত্রের কথায় আসা যাক। এক কে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে দুই দেখায়; দুটি থাকলে আরেকটি হয়, এক হতে বহু হয়। ব্যষ্টি অহং বা ছোট আমির পরিসর বৃদ্ধি হলে বা ব্যাপ্ত হলে তাকে বলা হয়- বড় অহং বা পাকা আমি -সমষ্টি বোধের অহং। ধ্যান চিত্তে যখন এই ব্যষ্টি হতে সমষ্টি অবধির ধারা রুদ্ধ হয়ে যায়, সুতরাং তখন হয় তা ‘অবাঙ্‌মনসোগোচরম্‌’। এই বড় অহং’ই ব্যষ্টির কাছে-আমাদের দিক দিয়ে- ত্বং বা তুঁহু-তত্ত্বমসি। আবার যখন সমষ্টি-ভাবে বড় অহং আছেন তখন সেই অহং এর ত্বং (আমির তুমিও) আছেন, এক জ্ঞান থাকলে দুই জ্ঞান থাকে। আমাদের দৃষ্টিতে দেখলে ত্বং কে আমরা ইদং বলি। এই বড় অহং ও ইদং (আমি ও আমির তুমি) অনাদি ও নিত্য বর্তমান। নিশ্চল অবস্থা ও সচল অবস্থা, নিষ্ক্রিয় অবস্থা ও সক্রিয় অবস্থা। স্থির অবস্থা অহং, চেতন বা ক্রিয়াশীল= ত্বং-ত্বংই মহাশক্তি। ঐ অহং-চ্যুত স্বতন্ত্র ইদং বা প্রকৃতি, জড়া-আবরণী ও বিক্ষেপ শক্তির খেলায় মোহগ্রস্ত। আবরণী ও বিক্ষেপ শক্তির খেলাতেই জগৎটি প্রবাহ রূপে নিত্য বোধ হয়। বীজ হতে গাছ হয়, গাছ হতে ফল হয়, বীজ হয়, সেই বীজ থেকে আবার গাছ হয়, কারণ হতে কার্য, কার্য হতে কারণ- এই যাওয়া আসা। কারণ কার্যে থাকে, কার্য ও কারণে থাকে।
স্থূলের সূক্ষ্ম হওয়া কে মৃত্যু বলে, সূক্ষ্ম স্থূল হলে হয় জন্ম। জন্ম মৃত্যুর এই অনাদি প্রবাহ চলেছে। একত্বে পৌঁছালে, কার্য কারণের একাত্ম হলে, জ্ঞানস্বরূপ হলে, এই জন্ম মৃত্যু আয়ত্তাভূত হয়, কর্মের প্রতাপ থাকে না, জন্মমৃত্যু দূরে পালায়। এটাই অমৃতত্ত্ব প্রাপ্তি। সৃষ্টি বোধে স্থূল সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম স্থূল, আবর্তন বিবর্তন রয়েছে। সুতরাং যে অবস্থায় এ সব রুদ্ধ, সে অবস্থায় অহং ও ইদং লীন অবস্থায় স্থিত, এই দুই তত্ত্বের (অহং ও ইদং এর) কোন কার্য’ই নেই। এটাই ব্রহ্মের চণকাকার ভাব (চণক= ছোলা বা মটর, দুটি দানা এক হয়ে আছে)। উহার বিভিন্ন নাম- আত্মরতি, পরাসম্বিদ, শ্রীগুরু, পরশিব, মহাদেব প্রভৃতি। ঐ ভাবকে তিন ভাবে বোঝা বা সাধন করা যায়, 
(১) পুং ভাবে- পুরুষভাবে, 
(২) শক্তিভাবে- নারীভাবে বা স্ত্রীমূর্তিতে, 
(৩) সচ্চিদানন্দভাবে। 
(শিব-মহাযোঢ়া-কুলার্ণব তন্ত্র দ্রঃ)। শিবই গুরু।
চণকাকার নির্গুণ, কেননা সেখানে গুণত্রয়ের সাম্য অবস্থা পরস্পর পরস্পরের দ্বারা পরাভূত হয়ে নির্গুণ। নির্গুণ হলেও একে নির্বিকল্প বলা যায় না, কারণ ওখান থেকেই অহং ইদং রূপ দ্বিত্ব ও তার থেকে আবার আবরণী ও বিক্ষেপ শক্তির আবির্ভাব সম্ভাবনা রয়েছে। চণকাকার দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জ্জিতং নয়। চণকাকার'ই ভাব-সমাধির শেষ সীমা-দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জ্জিতমের আভাষ। অহং ইদং (ত্বং) এখানে লীন অবস্থায় একাকার। দ্বন্দ্বাতীত স্থান বলেই এই ভূমি অদ্বৈত বা আনন্দ স্থান, সুতরাং জ্ঞানমূর্ত্তিং সাধন কালে সহস্রারেই এটা চিন্তনীয়। তন্ত্র বলেন, এই সহস্রার পূর্ণ পূর্ণেন্দু শুভ্রং আর পঞ্চাশদ্‌বর্ণরূপী হয়ে ‘তরুণরবিকলাকান্তকিঞ্জঙ্কপুষ্পং-বালসূর্যের ন্যায় সমুজ্জ্বল। সঙ্গীতময়ী কুণ্ডলিনী মূলাধার হতে উত্থিত হয়ে ঐ গান সংযুক্ত হন; ঐ স্থানেই আছেন ‘দেব পরমশিবঃ’। তিনি ‘খ’রূপী সর্বাত্মা হয়ে অজ্ঞান অন্ধকার দূর করছেন ও সেই স্থান হতেই ‘সুধাধারং নিরবধি বিমুঞ্চন্নতিতবাম্‌। যতেঃ স্বাত্মজ্ঞানং দিশতি ভগবন নির্ম্মলমতে।’ অর্থাৎ সেই স্থান হতে কৃপামৃতধারা প্রবাহিত হচ্ছে, তাঁর (শ্রীগুরুর) সুধাময় বাক্যে মোহনাশকারী আত্মজ্ঞান প্রকাশিত হচ্ছে। শব্দ ব্রহ্মময় সে স্থান। সে স্থান সকলেরই উপাস্য, কারণ ‘শিবস্থানং শৈবাঃ পরম পুরুষঃ বৈষ্ণবগণাঃ লপন্তীতিপ্রয়ো হরিহরপদং কেচিদপরে’- শৈব বলেন- শিবস্থান, বৈষ্ণব- পরম পুরুষস্থান, কেউ বা হরিহরপদস্থান, দেবীভক্তেরা- দেবী স্থান, যুগলানন্দ রসিক ভক্তেরা- হরগৌরীর শ্রীচরণকমল, মুনি ও পণ্ডিতেরা- প্রকৃতি-পুরুষস্থান বলেন। চণকাকার ব্রহ্মই সচ্চিদানন্দ স্থান। বেদ বলেন-
[‘তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দুরে তদ্বস্তিকে। তদন্তরস্য সর্ব্বস্য তদু সর্ব্বস্যাস বাহ্যতঃ,’ ঈশ/৫]
‘তা কাছে আবার কাছে না, দূরে আবার নিকটে, সকলের বাইরে। আবার সকলের অন্তরে!’ স্থির বা নির্গুণ ভাবই চণকাকার। নির্গুণ ভাবে ক্রিয়া নেই-নিষ্কম্প। দ্বন্দ্বাতীতং-দ্বৈতহীন-বহুত্ব-রহিত, সুতরাং ‘পরমসুখদং’- ‘অভয়ং অমৃতং’-ভয়-রহিত আনন্দ-স্থান। সক্রিয়ত্ব ও নিক্রিয়ত্ব -একেরই দুই দিক।
ঐ যে বালসূর্যের মত দীপ্তিমান, অথচ শুদ্ধরূপ প্রকাশশক্তি, যা হতে নিরন্তর সুধাধারা বর্ষিত হচ্ছে তার নাম শশিকলা। ঐ শশীর (চন্দ্রের) ষোড়শ কলা অর্থাৎ (কলা) ১৬ ভাগে বিভক্ত। সেটি ‘বিদ্দ্যুদামসমানকোমলতনু’ এবং অধোমুখী। অধোমুখী, কারণ সৃষ্টিমুখী -গানের অবরোহ। সাধক সূক্ষ্ম দৃষ্টি সহায়ে দর্শন করেন যে মস্তিষ্কের মধ্যভাগে এক পরম ধমনী আছে, সেই ধমনীর মধ্যবর্তিতায় পরমানন্দ রস উপলব্ধি-হয়, সেখান থেকেই ‘পূর্ণানন্দ পরম্পরাতি বিগলৎ পীযুষ ধারাধরা’-পিযুষ ধারা বর্ষিত হয়। শশিকলার মধ্যভাগে যেটি স্থিত, সেটাই নির্বাণকলা। এই কলা ‘চন্দ্রার্দ্ধসমানভঙ্গুরবতীসর্ব্বার্কতুল্য প্রভা।’ (ভঙ্গুরবতী=যা সময়ে সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা দেয়)। এই কলাই ‘নিত্যপ্রবোধোদয়া’-জীবের চেতনা বা প্রবোধ জনক জ্ঞানকে উদয় করায়। ঐ নির্বাণ শক্তির ‘মধ্যান্তরালে শিবপদমমলং শাশ্বতং যোগীগম্যং নিতানন্দাভিধানং সকল সুখময়ংশুদ্ধবোধস্বরূপং’ রয়েছেন। নির্বাণ শক্তিই পরশক্তি, তার অন্তরালস্থ শুদ্ধবোধ স্বরূপই পরশিব। তন্ত্র বলছেন যে ঐ স্থানকে কেউ কেউ নাম দেন ব্রহ্মস্থান, বৈষ্ণবেরা বলেন বৈষ্ণব স্থান, বোধ আনায়, (৩) রাগ- আকর্ষণ বিকর্ষণ এনে মোহ জন্মায়, (৪) পুরুষ(বিদ্যা)- সর্বজ্ঞ কে অল্পজ্ঞ দেখায়, (৫) কলা- সর্ব্ব পরিচালনক্ষম সামান্য কর্তৃত্বে মত্ত। ঐ পঞ্চভাবে খেলায় অহং ইদং সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়। তখন অহং, ইদংগত-ইন্দ্রিয়বোধাত্মিক অহং-কাঁচা আমি, ছোট আমি। পাকা ঘুঁটি কেঁচে যায় এই খেলায়। অতএব, পাকা আমি বা বড় অহং তখন সাধন বস্তু হয়ে যায়, অর্থাৎ ব্যষ্টি দেহযুক্ত মন, বৈচিত্র্যের জ্বালায় অস্থির হয়ে, বিরাট বা বিশ্বমনের দিকে যেতে চায়- ঐ অহং এ মিশে শান্তি পেতে চায়। 
ব্রহ্মের দুই লক্ষণ, স্বরূপ লক্ষণ ও তটস্থ লক্ষণ। দুই ভাবের সাধনার গন্তব্য স্থান এক। সত্তামাত্র, নির্বিশেষ, অবাঙ্মনসোগোচর যা তাহাই স্বরূপ লক্ষণ-বিশ্বে সৎ রূপে প্রতিভাত; যার সমদৃষ্টি সর্বত্র, যিনি দ্বন্দ্বভাব পরিশূন্য, নির্ব্বিকল্প, দেহাত্মাধ্যাসিবর্জ্জিত, তিনি সমাধিগম্য- এটাই তটস্থ লক্ষণ। এরই সত্ত্বা হেতু, সৃষ্টি স্থিতি লয় হয়। (মহানির্ব্বাণ, ৩য় উঃ ৭/৮ দ্রঃ)। ইনিই সগুণব্রহ্ম, সর্ব্বদেবতাময়, ‘গুণাতীতং গুণের্যুক্তং সৃষ্টিস্থিতিলয়াত্মকং’, সর্ব্বমন্ত্রময়, সর্ব্বকামদ, মহাজ্যোতির্ম্ময় সহস্রদলস্থ বিন্দু। 
বেদের ‘সোহকামযত বহু স্যাং প্রজায়েয’, এই সিসৃক্ষা বা আদি ইচ্ছা’ই তন্ত্রে দেবী আদ্যা বা ত্রিপুরা (ষোড়শী)। তন্ত্রে, সাধক ও সাধনা হিসাবে শক্তির নানা বিভাগ আছে। ত্রিপুরসুন্দরী, মহাত্রিপুরাসুন্দরী বা ষোড়শী, মহাষোড়ষী-একই সুন্দরী বিদ্যার অন্তর্গত-ষোড়ষীর অন্তর্গত। দেবীর দুই পাদবিক্ষেপ। প্রথম পাদবিক্ষেপে সৃষ্টি-সর্বসৌন্দর্য্যের প্রকাশ, তাই দেবী ষোড়শী সর্বসৌন্দর্য্যময়ী, মায়ের সৌন্দর্য্য ব্রহ্মাণ্ডে গড়িয়ে যাচ্ছে। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বহুত্বের প্রকাশ, খণ্ড খণ্ড সৌন্দর্য্যের মনবিমোহিনী শক্তি, বহুত্বে একত্বের ভাববিচ্ছিন্নতা-এ সমস্তেই মোহরূপ হলাহলের উৎপত্তি। সেই হলাহলের উগ্রতায় বহুর একত্বে ফিরে যাবার আশা লুপ্ত, হলাহলে সর্বভাবময়ী মায়ের দিব্যরূপ আবরিত। তাই সঙ্গে সঙ্গে দেবীর দ্বিতীয় পাদবিক্ষেপ। এই অসীম করুণামণ্ডিত পাদবিক্ষেপই গুরুশক্তি! ঐ হলাহলের সম্পূর্ণ দমন ও বিনষ্ট করার জন্য এই দ্বিতীয় পাদবিক্ষেপ-শ্রীগুরুমূর্তির উদয়-শবরূপী অহং সচেতন, মূর্ত। বহুর পথ অনুলোম প্রণালীতে; দেবীর গতি বিলোমে, তাই বিপরীত রতি। তন্ত্রে শ্রীগুরুই আদি শক্তি। 
পশ্চিমাদেশীয় পণ্ডিতদের মধ্যে বিখ্যাত গণিতবিদ Sanderson সাহেবই অনুমান করেন যে Time, matter and space are but a point- কাল, জড় ও দেশ, একটি বিন্দুমাত্র। নির্বাণ কলার কথা পূর্বে বলা হয়েছে। ঐ নির্বাণ কলার উর্দ্ধেস্থিত নির্বাণ শক্তি, তদূর্দ্ধে বিন্দু ও বিসর্গ। এই পর্য্যন্তই গুরুশিষ্য সম্বন্ধ, তারপর শিবের ৭ম মুখ অব্যক্ত। বিন্দু শূন্যগর্ভ। সেই শূন্য, অব্যক্ত- পূর্ণ। বিকৃত বৌদ্ধ শূন্যবাদ, তথা পশ্চিমাদেশীয় শূন্যবাদ ও হিন্দুর শূন্যবাদ- এই দুই শূন্যবাদে আকাশ পাতাল প্রভেদ। পশ্চিমা-দেশীয় শূন্য মানে অনস্তি, হিন্দুর নিত্য অস্তি। প্রবহমান নদীর উপমা দেওয়া হয়-নদীর স্রোত চলছে, জল স্থির নেই, নতুন নতুন জল প্রতিবারে আসছে প্রতিক্ষণে- মাঝে দাঁড়িয়ে আমি- প্রতি পলের সঙ্গে সময় যাচ্ছে, বয়সও বেড়ে চলেছে, কিছুই স্থির নেই। বৌদ্ধ বলেন, সুতরাং বর্তমান বলে কিছুই নেই, আছে শুধু অতীত ও ভবিষ্যৎ! উত্তরে হিন্দু বলেন, অতীত ও ভবিষ্যৎ ঠিক করছে কে ও কি দিয়ে ? তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ঠিক করবার স্থাপিতমানই (standard ই) যে বর্তমান। তাছাড়া, কালকে ভাগ করে দেখছে কে? সবই যে শক্তির ক্রিয়া, যা বোধ হচ্ছে নানা ভাবে, নানা অবস্থায়, বিভিন্ন আধারে। নিত্য অস্তি, নিত্য বর্তমান না থাকলে, সকল বোধের, সব গতির (standard) স্থাপিতমান কোথায় ? তাই মহাকাল, ‘যোহহমস্মি’- এই যে আমি- একলা আমি, এই বোধস্বরূপ, যা সব বোধ কে সম্ভব করে, আনন্দবিগ্রহ, আত্মচেতন নিত্য অস্তির প্রশান্ত- স্থিরের প্রথম চেতনানন্দ, শ্রুতির ভাষায়- ‘আকাশাত্মা সর্ব্বকর্ম্মা সর্ব্বকামঃ সর্ব্বগন্ধঃ সর্ব্বরসঃ সর্ব্বমিদমভ্যাক্তো অবাকী অনাদরঃ’। (ছা ৩/১৪/২)। ‘আকাশস্তল্লিঙ্গাৎ’ (ব্রহ্মসূত্র, ১/২৩)। ব্যাপ্তজ্ঞান- চিদাকাশই লিঙ্গ (লক্ষণ)। আকাশই (চিৎই) ব্রহ্ম- জ্যায় ও পরায়ণ, শ্রেষ্ঠ ও পরমগতি। তিনি পূর্ণ প্রকাশ, তিনি সব প্রকাশ করেন। 
[আ= সম্যক্‌, কাশতে= প্রকাশ পান বা, কাশয়তি= প্রকাশিত করেন। (রামানুজ)। প্রাণ= প্রণয়তি সর্বাণি ভূতানি (বিশ্বে প্রেরণা দেন) -রামানুজ।]
অতএব প্রাণঃ (ঐ ১/২৪), সমস্ত ভূত যাতে লয় প্রাপ্ত হয়, যা হতে সব আবার জাত হয় (ছাঃ)। প্রাণই ব্রহ্ম। এভাবে সবই ব্রহ্ম বলা হয়েছে। তৎ এজতি- কম্পনের প্রসার, কম্পনের বিস্তার, কম্পনে কম্পনে বেগ বৃদ্ধিত-তরঙ্গময়। বিশ্বমনের একাংশই ব্যষ্টিমন, তাই তা তরঙ্গময়। এই তরঙ্গের জন্যই নিত্য ও অনিত্য, বস্তু ও গুণ বোধ আসে-মন বাছাই করে। কোথায় থাকে দ্বন্দ্বভাব বা মন, যখন সব নিস্তরঙ্গ হয়ে যায় ? ভাবাভাবেব পারকে মন তাই ধরতে পারে না, তাই তা বাক্য মনের অতীত। তাই Art হচ্ছে ‘ভূঃ স্বাহা’ (সত্তামাত্র)-Being and Becoming। বিশ্ব-ঐ নিত্য অস্তির কাছে-আপাত প্রতীতি (apparent), সৎ’ই-নিত্য বর্তমান, নিত্য অস্তিই-Real-আসল। মন ভাগ করে, ভাগের পরিচয় হয় লক্ষণ দিয়ে, যার নাম গুণ, ক্রিয়াকে দেশে সাজায়। এটাও গতি, নাম, দূরত্ব নৈকট্য প্রভৃতি। গতিকে কালে সাজায়, নাম দেয় মুহূৰ্ত্ত, ক্ষণ, ঘণ্টা ইত্যাদি, এখানে (standard) স্থাপিত-মান সূর্য- গতিরই একটি ফল। কেন্দ্রীভূত গতির নাম স্থূল, তার কারণ গুলিকে আলাদা করে দেখলে নাম হয় সূক্ষ্ম। ঐ রকম জড় ও চেতন পৃথক করে দেখা হয়, যেটি apparent (প্রতীতি) মাত্র, Real (বাস্তব সত্য) হচ্ছে শক্তি, যেটি সর্ব চৈতন্য।
যখন শক্তির মধ্যে সমগ্র বিশ্ব বিলীন, তখন তমসার দ্বারা তমসা আবৃত- অন্ধকার উগরে আঁধার। বেদ বলছেন ‘আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং’, অর্থাৎ স্বধার সাথে একীভূত অবস্থায় ব্ৰহ্মচৈতন্য (আণীৎ= চৈতন্য) ছিলেন। (স্বধা= স্ব কে ধারণ = শক্তি, রূপ, আকার)। সমস্ত রূপ ধৃত হয়ে, ছিল অভেদ-ভাবে নিজ শক্তিতে (স্বধা)। এই চৈতন্যময় অভেদ গূঢ় তমস’ই দেবী আদ্যাশক্তি-আদ্যা কালিকা-রূপা। প্রলয়ের ঐ গূঢ় অন্ধকার-স্থির নিবাত-যাতে ভবিষ্যৎ দেশ কাল আদি বীজ নিহিত-তাঁকে মহা-তমোগুণ বলা হয়, ইনি মহাপ্রলয় মূর্তি। ইনিই মহত্তত্ত্ব-রূপী মহাকাল ভৈরব। আদ্যা-কালি, মহাকালে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে বিপরীত (প্রলয়ের বিপরীত= সৃষ্টি) ক্রীড়ায় রতা হন, নিহিত শক্তি আক্রমিত হয়ে প্রকাশ হতে আরম্ভ হয়, তাই প্রথম ঐ গূঢ় তমস। ক্রিয়া ব্যতীত শক্তির প্রকাশ বোঝা যায় না, বস্তুতে এই শক্তি ধৃত হয়। এই ধারণাশক্তির নাম আধার-শক্তি-পূজার আসন (যাতে সাধকের প্রার্থনা, ‘ধারয় মাং নিত্যং’-আমাকে সদা ধারণ কর)। এই নিহিত অসীম শক্তির অস্তিত্বই সৃষ্টি ক্রিয়ার কারণ। 
বেদে আছে, ‘সদেব সৌম্য ইদমগ্র আসীৎ একমেবাদ্বিতীয়ম। তদৈক্ষৎ বহু স্যাং প্ৰজায়েষ’ অর্থাৎ দ্বিতীয়-হীন সৎ অগ্রে ছিলেন, তিনি ঈক্ষণ করলেন-আমি বহু হয়ে প্রজাত হব। “ঈক্ষতের্ণা শব্দম্‌” [ব্রহ্মসূত্র ১/১/৫ (ঈক্ষণ দ্বারা সৎ এর বহুরূপে পরিণত হবার কথা, ভূতাদি সৃষ্টির কথা ছান্দোগ্যে বর্ণিত আছে, অ ৬/২/৩ হতে বিশদ বর্ণনা আরম্ভ হয়েছে]। সেই সৎ পুনঃ পুনঃ ঈক্ষণ দ্বারা সর্বত্র গূঢ়রূপে অন্তঃপ্রবিষ্ট হলেন। শ্রীশঙ্কর বলেন, ‘ব্রহ্ম জ্ঞানময়’, সুতরাং সচ্চিদেবই এই মনন বা বিবর্তন।
আমরা দেখতে পাই যে সমস্ত অবতার পুরুষদের, সব মহাপুরুষের করুণা উথলে ওঠে জগতের দুঃখ কষ্ট দেখে, তাই তারা আজীবন কর্ম করে যান। ঐ করুণাই তাদের ঈক্ষণ ও করুণা হৃদয়ই কাম-জগতের জ্বালা নিবারণই তাদের ঈপ্সিত বস্তু। জগতটার প্রকাশ যখন প্রলয়ের পর আবার হবার উপক্রম হয়, তখন বিশ্ব-বীজের নানাত্ব দেখে, সেই চিচ্ছক্তির বা মহাশক্তির আসে অনুকম্পা, তাই ঈক্ষণ করেন ও ‘অকাময়েৎ’। এর নামই কাম-গুরু-হৃদয়। তন্ত্রে এর নাম শিবকাম, ভক্তিশাস্ত্রে অপ্রাকৃত-কাম (প্রেম), তাই শ্রীকৃষ্ণের কাম-বীজ। ‘তৎসবিতুর্বরেণ্যম/ভার্গদেবস্য ধীমাহি/ধী যো যো নঃ প্রচোদয়াৎ’ (ঋক্‌ ৩য় ম ৬২/১০ সূঃ)-আমাদের ধীশক্তিকে যিনি প্রেরণা দেন। ছান্দোগ্য ৪/১০/৫ এ ব্রহ্মকে প্রাণ বলা হয়েছে, কাম ও বলা হয়েছে। জীবে এই প্রেরণা আসে কোথা হতে? “তন্নিষ্ঠস্যমোক্ষোপদেশাৎ” (ব্রহ্মসূত্র ১/১/৭ ) ব্রহ্মনিষ্ঠের উপদেশ হতে। গুরু বা আচার্য-এই দুজনের সম্বন্ধের কথা বেদে ভুরি ভুরি পাওয়া যায়। শিষ্য গুরুর কাছে শ্রদ্ধান্বিত হয়ে যান ঐ কামের প্রেরণায় গুরু শিষ্যকে উপদেশ দেন-যাতে তার মহা-কল্যাণ হয়- কামেরই প্রেরণা। কাম’ই দাতা (গুরু), কাম’ই গ্রহিতা, কাম’ই সর্বত্র দ্রষ্টা-রূপে থেকে সকলকে পূর্ণকাম করেন, কাম'ই প্রতি গ্রহিতা, কাম'ই সেই অপার ইচ্ছা-সাগর, কাম'ই আবার সেই সমুদ্রে বিলীন হন। অনুগীতায় ৩৭ অধ্যায়ে গুরুশিষ্য সম্বন্ধের কথায় বাসুদেব অর্জুনকে বলছেন, আমিই গুরু, অমার মনই শিষ্য।
মন, মননশীল-বিচার পরায়ণ-তাই চঞ্চল, ক্রিয়াশীল। মন চায় কার্য কারণ সম্বন্ধ। কার্য কারণের পারে যা তা অব্যক্ত। অব্যক্তের বহির্গতি মানে শক্তির বহির্গতি-শক্তির ক্রিয়া। শক্তির বহির্গতি হয়; শক্তি পূর্বাবস্থায় থাকে না-শক্তি ‘নিষেধব্যাপাররূপা’। নানা গতির স্পন্দনে প্রকাশ শক্তির আবির্ভাব হয়। শক্তির বহির্গতি-মন দুই ভাবে ভাগ করে বোঝার চেষ্টা করে, একটির নাম প্রাণ, অপরটি আকাশ (ব্রহ্মোপনিষৎ ১৯)। দুই-ই ব্যাপক-অসীম। ঐ ঈক্ষণ’ই, কাম’ই, প্রাণই সমষ্টি-ভাবে বিশ্ব-কুণ্ডলিনী, ব্যষ্টিতে ব্যষ্টির কাছে তার নাম কৃপাদৃষ্টি, সাধকের শ্রদ্ধা, জীবের কুণ্ডলিনী। আমরা যত রকম শক্তি-ক্রিয়া দেখি সে সকলের মূল স্থানই প্রাণ, বিশ্ব-বীজ-সর্ব সংস্কারের বীজ-যাকে আমরা জড়রূপে প্রকাশিত দেখি-ঐ সবের মূল-স্থানই আকাশ। আকাশে প্রেরণা আসে, আকাশের ওপর প্রাণের স্পন্দন হয়-বিশ্ব প্রকাশিত হয়। নানা ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়ে শক্তির ক্রিয়া বিন্দু-রূপে ফুটে ওঠে, বহির্গতি হয়, প্রতিবিম্বিত মনে আবার ফিরে আসে-প্রকাশ-বোধ আসে। অন্তর্গতিই বহির্মুখী হয়।
[চিৎ = জ্ঞান। বিজ্ঞানমাকাশং = চিদাকাশ (ব্ৰহ্মোপনিষৎ, ৩২ দ্রঃ)। বলা হয়েছে যে, চিদ্রূপী স্বচ্ছ আকাশ স্বরূপ ব্রহ্ম (তৎ) হৃদয় আকাশে প্রতিভাত হন। অবকাশাত্মক 'ভূতাকাশ’ নয়, কিন্তু যাতে সজগৎ প্রপঞ্চ ওতপ্ৰেত ভাবে বিদ্যমান, যে আকাশে ব্রহ্ম বিচরণ করেন, সেই আকাশই জ্ঞাতব্য। হৃদয়ের লক্ষণ= “হৃদয়ং তদ্বিজানীয়াদ্বিশ্বস্যাযতনং মহৎ"। বিশ্বের মহৎ আয়তন, যা হতে বিশ্ব প্রসূত হয়। হৃদয়ই পরমাত্মার ধ্যান-ভূমি। চিদাকাশই মূল আকাশ।]
সব আছে হৃদয়ে-অন্তরে। নিম্নস্তরে, সংস্কার সব জটিলতা পূর্ণ, মলিনতা পূর্ণ। বহির্গতির অন্তর্গতি হলে সব সংস্কার প্রাণময় হয়ে যায়, তখন শুদ্ধ-বুদ্ধির উদয় হয়, ঈক্ষণ কি উপলব্ধি হয়, রূপার বা করুণার অর্থ প্রকাশ পায়, প্রেম স্বতঃস্ফূর্ত হয়। 
তন্ত্রে প্রধানতঃ তিন প্রকার ধ্যানের ব্যবস্থা আছে। (১) নির্গুণ ধ্যান- ওঁ তৎসৎ বা যে কোন মহা-বাক্যের ধ্যান, সাক্ষিস্বরূপের- দ্রষ্টার ধ্যান, (২) বিরাটের ধ্যান = সমষ্টির ধ্যান, (৩) স্থূলের ধ্যান-চিন্ময়ী মূর্তির ধ্যান, জ্যোতির ধ্যান, প্রণবের ধ্যান। সৃষ্টির প্রকাশ আমরা দু’ভাবে দেখি, (১) বাহ্য জগৎ, (২) অন্তর্জগৎ-মন-বুদ্ধির জগৎ। এই দুই-ই স্ব-প্রকাশ। এই অন্তর বাহিরে প্রকাশমান শক্তির, এই সমষ্টির নামই বিরাট। সুতরাং বিরাটই সর্বান্তর্যামী (অন্তরাত্মা) ও সর্বব্যাপী-সত্য। এই সত্যকে ধরবার জন্যই, সত্যকে অংশে অংশে, বহুভাবে বুঝতে হয়, তখন প্রত্যেক বস্তুর স্বাতন্ত্র্য বোধ আসে। এই বোধ, প্রতি বস্তুর অবয়বের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িত, যে, এই খণ্ডিত বোধ বা কাঁচা আমির জ্ঞানকে জ্ঞেয় বস্তুর সঙ্গে পৃথক করা যায় না-বিচারে স্বতন্ত্র বোধ হলেও। কিন্তু ঐ সমষ্টিরূপী বিরাট অহং এ জ্ঞেয় ও জ্ঞান একাত্ম অর্থাৎ ঐ বড় অহং’ই বিজ্ঞাত বা সর্বজ্ঞ। ইন্দ্ৰিয়জ্ঞান দ্বারা ঐ জ্ঞানকে বোঝা যায় না, কারণ, ইন্দ্রিয় তাকে ছুতে, ধরতে, দেখতে পায় না; ইনি দ্রষ্টা, সাক্ষিচৈতন্য, স্বসংবেদ্য-সর্ব্বপ্ৰকার জ্ঞানের আশ্রয়। বিরাট, জাগ্রতাভিমানী পুরুষ; এর নিদ্রা, জাগরণ বা কোন অবস্থার পরিবর্তন নেই। পরিবর্তন হয় জ্ঞান ও জ্ঞাতার সম্বন্ধে-ঐ দুয়ের সম্পর্ক আলো ও অন্ধকারের ন্যায়। আলো সরিয়ে নিলে কিছুই দেখা যায় না, জ্ঞানকে সরিয়ে নিলে জ্ঞেয় পালাবে। একই বহুরূপে প্রতীয়মান; প্রমাণ-সাধন সম্ভূত প্রত্যক্ষ জ্ঞান। 
দেবী কালিকায়, নিমেষ উন্মেষ শক্তি মিলিত, উন্মেষই বিরাট। চরাত্মক ব্ৰহ্মশক্তির নাম হিরণ্যগর্ভ-স্বপ্নাভিমানী, জড়াত্মক ব্রহ্মশক্তিই আকাশ। চিৎ ও জড়ের (চিজ্জড়ের) স্বস্থিতি ব্যাপার সম্ভব হয় যে শক্তিতে সেই শক্তির নাম প্রাণ। প্রাণ ও আকাশের মিলন-ভূমির নাম ঈশ্বর, অতএব ঈশ্বরেরই সৃষ্টি কল্পনা। সৃষ্টি ব্যাপারে প্রধানতঃ দুটি শক্তির খেলা দেখা যায়, (১) দৃশ্যশক্তি বা জড়শক্তি, যেমন চুনে হলুদে মেশালে লাল হয়, (২) সূক্ষ্ম-শক্তি বা অদৃশ্য-শক্তি (মানস শক্তিও অদৃশ্য), যেমন হজম বা রক্ত চলাচল ব্যাপার, জীবের অজ্ঞাতসারেই হয়। ঐ দুই শক্তির নাশেই প্রলয়। তখন সূক্ষ্ম-শক্তি বা মানস শক্তি স্বীকারণে লয় হয়। এই লয় অবস্থায় মানসশক্তির উপাদানকারণেব নাম প্রাণ, আর জড়শক্তির উপাদান কারণের নাম আকাশ। আকাশ হতেই পঞ্চ মহাভূতের উৎপত্তি হয়, আর ঐ প্রাণই ভূত শরীরে পাঁচভাগে বিভক্ত হয়ে পঞ্চ বায়ু (দশ বায়ু=বহির্বায়ু) নামে প্রকাশ পায়।  

[সমস্ত করণের(ইন্দ্রিয়ের) সাধারণ অর্থাৎ মিলিত বৃত্তিই পঞ্চপ্রাণ= প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান, (সাংখ্য প্রবচন সূত্র ২য় অঃ। ৩১ দ্রঃ)। মহর্ষি কপিল সাংখ্যদর্শন প্রণেতা। ঐ দর্শন সম্বন্ধে মূল তিনটি বই প্রসিদ্ধ, (১) অতি সংক্ষিপ্ত, ২২টি সূত্রে গ্রথিত ‘তত্ত্বসমাস', (২) ঈশ্বর কৃষ্ণাচাৰ্য্যের ‘সাংখ্য কারিকা’ (৭২টি সূত্র) । এই কারিকাটি গুরু পরম্পরায় প্রাপ্ত ও প্রাচীন, (৩) সাংখ্যপ্রবচন সূত্র, কপিলের শিষ্য আসুরী, আসুরীর শিষ্য পঞ্চ শিখাচাৰ্য্য কর্তৃক বিস্তৃতভাবে সাংখ্য-কারিকার সমুদয় তত্ত্ব এবং তত্ত্বসমাসের বিস্তৃত ব্যাখ্যা যাতে আছে তাহাই ‘সাংখ্যপ্ৰবচন’ নামে পরিচিত।]
তন্ত্রে সৃষ্টিতত্ত্ব সমাপ্ত



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.