sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-০৭

৩। অপৌরুষেয়ত্ব বিষয়ে বিতর্ক ও মীমাংসা।

বেদ যে পৌরুষেয় তার পক্ষে যুক্তি-

বেদের অপৌরুষেয়ত্ব প্রমাণ পক্ষে প্রধানতঃ ত্রিবিধ যুক্তির অবতারণা দেখতে পাই। এক পক্ষ বেদকে সাধারণ মানুষের রচনা বলে ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় পক্ষ একে অভ্রান্ত পুরুষের রচনা বলেন। তৃতীয় পক্ষ উহা ঈশ্বর-প্রণীত বলে সিদ্ধান্ত করেন। কালিদাস ‘রঘুবংশাদির’ রচয়িতা; ‘উত্তররাম চরিত’ প্রভৃতি ভবভূতির রচনা; বেদও তেমনি পুরুষ বিশেষের রচনা বলে বিতর্ক উপস্থাপন হয়। সাধারণ গ্রন্থ প্রভৃতি দেখে যেমন তার প্রণেতার বিষয় মনে আসে, বেদ দেখেও সে ভাব মনে আসবে না কেন? এই প্রথম পক্ষের সিদ্ধান্ত। আবার, নৈয়ায়িকগণ এক ভাবে, বৈশেষিক-দর্শন আর এক ভাবে এবং বেদান্ত অন্য আর এক ভাবে এ বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন। নৈয়ায়িকগণ বলেন- ‘বেদকর্ত্তা যথার্থবাদী হতে পারেন, বেদ অভ্রান্ত পুরুষের প্রণীত হতে পারে; কিন্তু উহা যে কারও রচনা নয়, তা বলা যেতে পারে না। কুম্ভকার ঘট প্রস্তুত করল; সে স্থানে ‘ঘট’ প্রস্তুত করল’ এই বাক্য নিশ্চয়ই সত্য। বেদে সেরূপ সত্য আছে বলেই উহা অভ্রান্ত-পুরুষের রচনা বলা যেতে পারে; কিন্তু উহা অপৌরুষের অর্থাৎ কারও রচিত নয় বলা যেতে পারে না। বাক্য অভ্রান্ত হলেই যে তা নিত্য ও অপৌরুষেয় হবে, তার কোনও কারণ নাই। তবে বেদ যখন অভ্রান্ত ও সত্যস্বরূপ, উহা ভ্রান্ত মানুষের রচনা হতে পারে না; উহা অভ্রান্ত-পুরুষের-ঈশ্বরের রচনা। ঈশ্বরের রচনা বলেই উহার প্রামাণ্য। তাছাড়া এর অপৌরুষেয়ত্ব নেই। বৈশেষিক-দর্শনের মতও অনেকাংশে ঐরূপ ভাবদ্যোতক। দর্শনকার সূত্রে(প্রথম অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, তৃতীয় সূত্র) বলেছেন,- “তদ্বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্‌।” অর্থাৎ বেদ ঈশ্বরবাক্য, অতএব প্রমাণ। অর্থান্তরে, বেদ ধর্ম-প্রতিপাদক ঈশ্বরবাক্য, সুতরাং প্রমাণ। বৈশেষিক-দর্শনের অন্য আর এক সূত্রে বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বিবৃত দেখি। সেই সূত্র (ষষ্ঠ অধ্যায়, প্রথম আহ্নিক, প্রথম সূত্র)- “বুদ্ধিপূর্ব্বাবাক্যকৃতির্বেদে।” অর্থাৎ, বেদবাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্ব্বক হয়েছে। বেদে বিধি নিষেধ রূপ যে সকল বাক্য আছে, তা ধর্ম-মূলক। ধর্মাধর্মের প্রমাণ তাই বেদ। সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর সে বেদ রচনা করেছেন বলেই তার অভ্রান্ততা। ‘স্বর্গকামো যজেৎ’; অর্থাৎ, যাগযজ্ঞই স্বর্গকামী ব্যক্তির ঈষ্টসিদ্ধির কারণ; ‘গাং মা বধিষ্ঠাঃ’; অর্থাৎ, গো-বধ করিও না; কেননা, ইহা স্বর্গকামী ব্যক্তির ইষ্টসিদ্ধির অন্তরায়;- এই প্রকার যে বেদোক্ত বিধি-নিষেধ, ইহা কি কখনও মানুষে রচনা করতে পারেন? স্বর্গ অপবর্গের কথা সাধারণ মানুষের অধিগম্য নয়। এমন যুক্তির অবতারণা করেই বৈশেষিক দর্শন ধর্মাধর্ম প্রতিপাদ্য বেদকে ঈশ্বরবাক্য বলে ঘোষণা করে গেছেন। যার অসংখ্য শাখা, যার অশেষ সন্মান, বৈশেষিকের মতে, তা অভ্রান্ত-পুরুষের- ঈশ্বরের রচনা ভিন্ন কারও রচনা হতে পারে না। এইমতে, বেদ ঈশ্বর-প্রেরিত এবং মহাজনগৃহীত; আর, তার জন্যই এর প্রামাণ্য। বেদ-বিষয়ে বেদান্ত-দর্শনের যে সিদ্ধান্ত, তাতেও এইপ্রকার অভিমত অভিব্যক্ত। বেদ যে ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন হয়েছে, ‘শাস্ত্রযোনিত্বাৎ’ (বেদান্ত-দর্শন, প্রথম পাদ, তৃতীয় সূত্র) সূত্রে এ তত্ত্ব ব্যক্ত। বেদ ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন, ব্রহ্মই বেদের সৃষ্টিকর্ত্তা; উক্ত সূত্রে এই অর্থ প্রতিপন্ন হয়। ফলতঃ, সাধারণ পুরুষ বা মনুষ্য নয়; পরম-পুরুষ পরমেশ্বর কর্তৃক বেদ সৃষ্ট হয়েছিল। বেদের পুরুষ-সুক্ত মন্ত্র অনুসারেও বেদকে পৌরুষেয় বলা যেতে পারে। কেন-না, উক্ত সূক্তে বেদ-বিধাতা ভগবানকে ‘সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ’ অর্থাৎ সহস্র-মস্তক সহস্র চক্ষু ও সহস্র-পাদ-বিশিষ্ট পুরুষ বলা হয়েছে। সেই পুরুষ হতেই যখন বেদ উৎপন্ন, তখন বেদকে অবশ্যই পৌরুষেয় বলেই অঙ্গীকার করতে হয়। 

বেদের অপৌরুষেয়ত্বে প্রমাণ-

এই প্রকারে বেদের পৌরুষেয়ত্ব-স্থাপনে যে সকল বিতর্ক উত্থাপিত হয়, বিবিধ যুক্তি দ্বারা তার সমস্ত খণ্ডনের প্রয়াস দেখতে পাই। প্রথমতঃ, কালিদাস ভবভূতির ন্যায় কোনও মানুষ যে বেদ-রচয়িতা ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। কালিদাস ‘রঘুবংশ’ প্রণয়ন করেছিলেন; ভবভূতি কর্তৃক ‘উত্তররামরচিত’ বিরচিত হয়েছিল; -এর সাক্ষ্য পুরুষ-পরম্পরা ক্রমে প্রাপ্ত হওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেদ-প্রণেতার কোনই পরিচয় নেই। কেউ হয় তো মনে করতে পারেন, মধুচ্ছন্দা ঋষি প্রভৃতি যাঁদের নামে বৈদিক সূক্তসমূহ প্রচারিত আছে, তাঁরই বুঝি সেই সেই সূক্তের রচয়িতা। কিন্তু এ বিষয় পূর্ব্বেই প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাঁদের কে মন্ত্রের রচয়িতা বলা যেতে পারে না; তাঁরা মন্ত্রের প্রবর্ত্তক মাত্র।  তারপর, বৈশেষিক দর্শনের এবং বেদান্ত-দর্শনের সিদ্ধান্তের আলোচনায় বেদ যে পরমেশ্বর-রচিত বলেই সূচিত হয়, তার দ্বারাও এর পৌরুষেয়ত্ব প্রতিপন্ন হয় না। কেন-না, পুরুষ বলতে - মানুষ বলতে, কর্মফল-হেতুভূত এই জন্মজরামরণশীল দেহধারী জীবকেই বুঝায়। কর্মের ফলে জীবকে নরদেহ ধারণ করতে হয়। সেই নরদেহধারী জীবই সাধারণতঃ পুরুষ নামে খ্যাত। কিন্তু জগৎপাতা জগদীশ্বর সেরূপ পুরুষ নন। আবশ্যক অনুসারে পুরুষ-রূপে আবির্ভূত হলেও, তিনি সাধারণ পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না; কেনন-না, কর্মফলের অধীন হয়ে, কর্মফলভোগ-হেতু তাঁকে সংসারে আসতে হয় নি; সুতরাং পুরুষ হয়েও তিনি পুরুষাতীত। আর, সে অনুসারে পৌরুষের হয়েও তাঁর রচনা অপৌরুষেয়। এই পৌরুষেয় -অপৌরুষেয় প্রসঙ্গে সাংখ্য মতাবলম্বিদের যুক্তি আবার আরেক প্রকার। তাঁরা বলেন, ‘পুরুষ নিষ্ক্রিয় মুক্ত সৎস্বরূপ। কোনও বিষয়ে তাঁর ইচ্ছাই আসতে পারে না। সুতরাং তিনি যে বেদ রচনা করেছেন, তা কিভাবে বলতে পারি?-ইচ্ছাপূর্ব্বক কোনও কার্য্য করা-বদ্ধ-পুরুষের লক্ষণ। অতএব, বুদ্ধিপূর্ব্বক বেদ রচনা হয়েছে যদি স্বীকার করা যায়, তাহলে পুরুষকে পরমেশ্বরকে বদ্ধ-জীব বলেই স্বীকার করতে হবে। বদ্ধজীবে মুক্ত-সত্য-ভাব কখনই সম্ভবপর নয়। পুরুষ মুক্ত সত্য; সুতরাং বেদ তাঁর রচনা হতে পারে না।’ তবে তাঁর থেকে বেদ কিভাবে উৎপন্ন হতে পারে? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,- ‘অদৃষ্টবশতঃ স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মার নিশ্বাসের ন্যায় বেদের উৎপত্তি হয়েছে। পুরুষ হতে অনুসৃত হলেই যে তা পৌরুষেয় হল, তা বলতে পারি না। সুষুপ্তি-কালে, নিদ্রিত অবস্থায়, মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত হয়। তাকে কি ইচ্ছাকৃত পৌরুষেয় সংজ্ঞায় অভিহিত হয়ে থাকে। পুরুষ-যিনি পরমপুরুষ, তাঁতে ইচ্ছা ও অনিচ্ছা কিছুরই আরোপ করা যায় না। সুতরাং বেদ পৌরুষেয় নহে। তবে বেদ কোথা হতে আসল? সাংখ্যগণ উত্তরে বলেন,-বেদ অনাদি; বীজাঙ্কুরবৎ। বৃক্ষ আদি, কি বীজ আদি-ইহা যেমন নির্ণয় হয় না; জ্ঞান-রূপ বেদেরও সেরূপ উৎপত্তি ও লয় নির্ণয় হয় না। যা পুরুষ(সাধারণ মনুষ্য) কৃত, তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু জ্ঞানের আদি-অন্ত কে নির্ণয় করতে পারে?’ সুতরাং বেদ অনাদি অপৌরুষেয়। 
চলবে--------------------------------
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ 

1 টি মন্তব্য:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.