গীতার আদর-০২
গীতা গ্রন্থকে মানুষের মত জীবন্ত মনে করে সম্বোধন করা হয়েছে। অনেকে মনে ভাবতে পারেন ইহা কি প্রকার ভক্তি?
পুস্তুক আবার মানুষের মত কিভাবে হবে ? আবার কেউ কেউ ইহা সত্যও ভাবতে পারেন। "গীতা মে হৃদয়ং পার্থ"। যা শ্রীভগবানের হৃদয় তা জড় বলে নাই ভাব হল-এতে কি কিছু অতিরঞ্জিত আছে ? মানুষের হস্ত পদ চক্ষু কর্ণাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়; এগুলিকে মানুষ বলা হয় না। স্থুল আবরণ গুলিকে জীবন্ত করে যে চৈতন্য পুরুষ বিরাজিত, তিনিই মানুষ।
জড় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবলম্বন করেই তিনি প্রকাশ পেয়ে থাকেন। গীতা গ্রন্থের অক্ষরগুলিকে শব্দমাত্র বলা হলেও সেই শব্দরাশির অর্থ দ্বারা যে আত্মদেব প্রকাশিত তিনিই শ্রীগীতা। ইনিই সমকালে অক্ষর বা অব্যক্ত বা নির্গুণ ব্রক্ষ, ইনিই সগুণ ব্রক্ষ বা বিশ্বরুপ, ইনিই মায়ামানুষ বা মায়া-মানুষী, ইনিই প্রতি জীবের আত্মা। জড় আবরণটি মায়া, ভিতরের হৃদয়টিই আত্মদেব বা আত্মদেবী।
এই আত্মদেব বা আত্মদেবীর নাম সম্বন্ধে শাস্ত্র বলছেনঃ-
গীতা নামানি বক্ষ্যামি গুহ্যানি শৃণু পাণ্ডব।
কীর্ত্তনাৎ সর্ব্বপাপানি বিলয়ং যান্তি তৎক্ষনাৎ॥
গঙ্গা গীতা চ সাবিত্রী সীতা সত্যা পতিব্রতা।
ব্রহ্মাবলির্ব্রহ্মবিদ্যা ত্রিসন্ধ্যা মুক্তিগেহিনী॥
অর্দ্ধমাত্রা চিদানন্দা ভবঘ্নী ভ্রান্তিনাশিনী।
বেদত্রয়ী পরানন্দা তত্ত্বার্থজ্ঞানমঞ্জরী॥
ইত্যেতানি জপন্নিত্যং নরো নিশ্চল-মানসঃ।
জ্ঞানসিদ্ধিং লভেন্নিত্যং তথাহস্তে পরমং পদম্॥
হে অর্জুন! গীতার গুহ্য নাম সকল আমি বলছি শ্রবণ কর। এই নাম সকল কীর্ত্তন করলে পাপরাশি তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হয়।
গঙ্গা, গীতা, সাবিত্রী, সীতা, সত্যা, পতিব্রতা, ব্রহ্মাবলি, ব্রহ্মবিদ্যা, ত্রিসন্ধ্যা, মুক্তিগেহিণী, অর্দ্ধমাত্রা, চিদানন্দা, ভবঘ্নী, ভ্রানিনাশিনী, বেদত্রয়ী, পরানন্দা, তত্ত্বার্থজ্ঞানমঞ্জরী ইত্যাদি নাম যিনি নিশ্চল-চিত্তে নিত্য জপ করেন, তিনি সর্বদার জন্য জ্ঞানসিদ্ধি লাভ করেন, এবং অন্তে পরম শান্ত নিশ্চল আনন্দ স্বরূপ বিশ্বতৈজস প্রাজ্ঞ এই ত্রিপাদের উর্দ্ধে যে পরম পদ তাতে প্রবিষ্ট হয়ে স্থিতিলাভ করেন।
সর্বজ্ঞান-প্রয়োজিকা ধর্মময়ী শ্রীগীতাকে শ্রীভগবান্ বলছেনঃ-
গীতা মে হৃদয়ং পার্থ! গীতা মে সারমুত্তমম্।
গীতা মে জ্ঞানমত্যুগ্রং গীতা মে জ্ঞানমব্যয়ম্॥
গীতা মে চোত্তমস্থানং গীতা মে পরমং পদম্।
গীতা মে পরমং গুহং গীতা মে পরমো গুরুঃ॥
শ্রীভগবান্ বলছেন- গীতাই আমার হৃদয়, গীতাই আমার উত্তম সার, গীতাই আমার অত্যুগ্র অব্যয়-জ্ঞান, গীতাই আমার রমণীয় বাসভবন, গীতাই আমার পরম পদ। অধিক কি গীতাই আমার পরম গুহ্য; গীতাই আমার পরম গুরু।
শ্রীভগবানের পরম গুরু যিনি তাঁকেও চৈতিন্যময়ী বলতে কি আপত্তি হতে পারে ?
শেষ কথা।
"কৃষ্ণো জানাতি বৈ সম্যক্ কিঞ্চিৎ কুন্তীসুতঃ ফলম্।
ব্যাসো বা ব্যাসপুত্রো বা যাজ্ঞবল্ক্যোহথ মৈথিলঃ॥"
যাঁর সম্বন্ধে বলা হয় কৃষ্ণই সম্যক্ জানেন, অর্জুন কিঞ্চিৎ ফল অবগত, ব্যাসদেব বা শুকদেব বা যোগী যাজ্ঞবল্ক্য বা জনক কিঞ্চিৎ মাত্র জানেন, তাঁর সম্বন্ধে অকিঞ্চন এই ছার জীবে কি জানবে? তথাপি কোন্ সংস্কারবশে এই অসাধ্য সাধনও ছাড়তে দাও না, তা বুঝব কিভাবে ? জীব কি আপন ইচ্ছায় এইরূপ কার্য্য করে, অথবা তোমার ইচ্ছায় চালিত হয়ে এইরকম কার্য্যে প্রবৃত্ত হয় তা কে বুঝিয়ে দিবে ? অথবা বুঝারই প্রয়োজন কি ?
হে অগতির গতি! যে দিক দিয়েই নিয়ে যাও, হে আত্মদেব! আমাদের এই কর, যেন সকল কাজে মানুষ তোমার অনুগ্রহ কামনা ভিন্ন অন্য কামনা না করে, যেন সমস্ত ফলকামনা ত্যাগ করে, তোমার আজ্ঞা পালন করতে করতে তোমার আশ্রয়ে নিরন্তর থাকতে পারে। জনন মরণে তুমি মাত্র আশ্রয় দাতা। হে অধম জনের ত্রানকর্ত্তা! হে পতিতপাবন! হে পাপীতাপীর আশ্রয়! হে ক্ষমাসার! হে আমার দেবতা, হে আমার প্রভু! কি আর বলব, প্রার্থনা করতেও জানি না। তথাপি এই বলি, ভৃঙ্গ যেমন কমল মধ্যে ডুবে থাকলে আরাম পায়-তাপত্রিতয়-জ্বালামালাকুল আমরা যেন সর্বদা এই জ্বালা অনুভব করে, কাতর হয়ে তোমাকে ডাকতে ডাকতে, তোমার পরমপদে, তোমার মধুর চরণ কমলে, চিরস্থিত লাভ করতে পারি। হে অব্যক্ত-স্বরুপ! হে বিশ্বরুপ! হে স্বেচ্ছাধৃত-বিগ্রহ! তোমার এই ত্রিবিধ রূপ দর্শন করব, এই উৎকন্ঠাস্ফুটিত চিত্তে যেন নিরন্তর তোমাকে স্মরণ করে কৃতার্থ হতে পারি, প্রভু এটাই প্রার্থনা।
গীতা পরিচয় এ গীতার আদর সমাপ্ত।
খুব সুচিন্তিত
উত্তরমুছুন