sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

ধর্মের চারটি অঙ্গ ও তার প্রয়োগ -

শ্রীমদ্ভাগবত-মহাপুরাণ  অনুধ্যান

ধর্মের চারটি অঙ্গ ও তার প্রয়োগ -


যে কোন ধর্মকে সুষ্ঠ ভাবে, স্থির ভাবে চলতে গেলে, ধর্মকে শক্তিমান হতে গেলে চারটি অঙ্গের দরকার, এই  চারটি অঙ্গ  হল – ১) দর্শন, ২) পুরাণ  ৩)  তন্ত্র  বা পূজা  উপাচার ও ৪) স্মৃতি।
উপনিষদ হিন্দু ধর্মের দর্শনের কথা বলছে, তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মের পূজা-উপাচার, পুরাণে ভগবান ও অবতারদের লীলা কাহিনী আর স্মৃতিগ্রন্থে হিন্দুদের সামাজিক আচার আচরণ বিধির আলোচনা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি বিভাগেই যে যার নিজেদের মধ্যে সম্পূর্ণ। অন্য দিকে ধর্মের এই চারটি অঙ্গই ভাগবতে পাওয়া যাবে। পৌরাণিক কাহিণী এর ভিক্তি হলেও ভাগবতেও আমরা হিন্দু দর্শনের অনেক কিছুই পেয়ে যাই। আবার ভগবানকে কিভাবে পূজা, প্রার্থনা করতে হবে তারও বর্ণনা আছে, আর মানুষকে সমাজে ও পরিবারে থাকতে গেলে কি ধরণের আচার ব্যবহার করতে হবে তাও বলা আছে। কেউ যদি মনে করে আমি সারা জীবন শুধু ভাগবতই অধ্যয়ন করে যাব আর একেই অনুসরণ করে চলব তা হলেও সে ভাগবতের মধ্যেই হিন্দু ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ রূপে পেয়ে যাবে, তাকে আর আলাদা করে উপনিষদ বা স্মৃতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করার প্রয়োজন হবে না।
মাঝে একটা রব উঠেছিল মানবিকতাই ধর্ম, মানুষকে ভালোবাসাই ধর্ম। আরেকটা রব উঠেছিল বিজ্ঞানই ধর্ম। পাশ্চাত্য জগতের চিন্তাবিদরা যখনই কোন কিছু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তখন তারা সেই বিষয়ের অনেক গভীরে চলে যান। আমাদের আগেকার ঋষিরা যাঁরা ছিলেন তাঁরাও সব কিছুর গভীরে গিয়ে তার সার তত্ত্বটাকে উদ্ধার করে আনতেন। কিন্তু ইদানীং কালে আমাদের পণ্ডিতদের মধ্যে সেই গভীরে যাওয়ার ব্যাপারটা দেখা যায় না। এই কারেণই ভারতে কেউ নোবেল প্রাইজ পায় না। বিজ্ঞানে না হয় পাশ্চাত্য জগৎ অনেক এগিয়ে আছে কিন্তু সাহিত্যে ও একমাত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কেউ নোবেল প্রাইজ পেলেন না। অথচ ভারতীয়দের নামে একটা খুব সুনাম, তাদের মত উপদেশ, জ্ঞান দেওয়ার মত লোক নাকি সারা পৃথিবীতে নেই, আসলে এটা অপবাদ বা প্রশংসা কিনা বলা যায় না। কিন্তু এটা ঠিক যে ভারতীয়রা শুধু কথাই বলে, রাস্তা-ঘাটে, ট্রেনে বাসে সবাই কথা বলে যাচ্ছে, সবাই সাহিত্য রচনা করে যাচ্ছে। তার কারণ হল এখন কারুর মেধ্যে সেই গভীর চিন্তাটা নেই। যেখানে একটা বিষয়ে আপনি প্রভুত্ব করবেন, যার জন্য জগৎ আপনার দিকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখবে, তার জন্য যে গভীর চিন্তন দরকার সেটাই ইদানীং কালে আমাদের হারিয়ে যচ্ছে। আমাদের ঋষিরা যে বিষয়কে বেছে নিলেন সেই বিষয়ের উপরই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। কোন কিছুর জন্য জীবনকে পুরোপুরি উৎসগ´ করে দেওয়ার এই মনোভাবটা ভারত থেকে এখন প্রায় উঠেই গেছে। আমাদের সব কিছুই এখন ভাসা ভাসা, ওপর ওপর দিয়ে যা কিছু করার করে যাচ্ছে।
বিদেশীরা যারা ধর্ম জানে না, ধর্ম বোঝ না, তারাও ধর্মকে নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করছে, সেই তুলনায় আমাদের দশের এখন কেউই তেমন কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছ না। ভারত এখন যুক্তিবাদীরা নানা রকম মতবাদ নিয়া আসছে। যখন বলছে যুক্তিবাদটাই ধর্ম, তার আগে বলতে হবে ধম´জিনিষটা কি। আপনি বলবেন আমি ধমে´র নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছি। নতুন ব্যাখ্যা দিতে হলে তার শব্দটাও নতুন দিতে হবে, তখন ‘ধম´’ না বলে  অন্য কোন  শব্দ বলতে হবে। কারণ হাজার হাজার বছর ধরে শব্দের যে পরিভাষা পরস্পরাতে চলে আসছে সেটাকে কারুর খামখেয়ালীতে পাল্টে দেওয়া যায় না।
আসলে ধর্ম কি? ধর্ম একটি বিচার। যার জন্য বেশ কয়েকটি জিনিষের দরকার। প্রথম দরকার ধর্মকে একটা জীবন দর্শন দিতে হবে, জীবনের সত্যটা কি বলতে হবে। কোন পথে চলতে চলতে একদিন সেই সত্যে পৌঁছাতে পারবে, সেটাও বলতে হবে। যেমন বেদান্ত বলছে সবং খল্বিদং ব্রহ্ম। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোণ দিয়ে কোন মুসলমান বলবে আল্লাই আছেন, আল্লা ছাড়া কিছু নেই, আল্লাই সত্য। দর্শন শুধু আমাকে তত্ত্বটা জানিয়ে দিচ্ছে, সত্যটা কি বলে দিচ্ছে। কিন্তু সেই তত্ত্বে পৌঁছানোর প্রথম পথ হল বিচার, আমাকে বিচার করে করে এগোতে হবে। দ্বিতীয় পথ হল অর্চনা, উপাচার। আমি যদি অর্চনা, পূজা উপাচার করি তাহলে এই উপাচার পদ্ধতি আমাকে সেই সত্যে পৌছে দেবে যেখানে বিচার করে পৌছান যাচ্ছে। তৃতীয় পথ, সামাজিক যে আচার আচরণ বিধি পালন করার কথা ধর্মশাস্ত্র বলে দিয়েছে শুধু সেগুলোকে পালন করেও আমি সেই সত্যে পৌঁছে যেতে পারি। আর চতুর্থ হল, পুরাণের ভগবানের লীলা কথা এবং অন্যান্য শাস্ত্রে ভগবানকে নিয়ে যে কথা কাহিনী আছে তার অনুচিন্তন করেও আমি সেই সত্যে পৌঁছে যেতে পারি। বিজ্ঞানকেই যাঁরা ধর্ম বলে বিশ্বাস করেন তাঁরা খুব হলে বলবেন এনার্জিই শেষ কথা। কিন্তু তারপর এণার্জির পর কি আছে বলতে পারবেন না। এণার্জিই শেষ কথা খুব ভালো। এবার ওখানে পৌঁছানোর জন্য আমার আচার, উপাচার আর আমার সামাজিক আচরণ বিধি কি হবে, যা পালন করে আমি ওই এণার্জি লেভেলে পৌঁছাতে পারবো? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর বিজ্ঞানের কাছে নেই।
আমাদের মনে হতে পারে সব কটি পথই একটি থেকে আরেকটি  সম্পুর্ণ আলাদা। আসলে তা  নয়, সব পথই একে অপরের সাথে মিলে মিশে রয়েছে, তবে বিশেষ একটি শাস্ত্র বিশেষ একটি পথের উপর বেশী জোর দিয়েছে। যেমন উপিনষদ ও বেদান্ত বিচারের উপর বেশী জোর দিচ্ছে। কিন্তু উপিনষদেও কথা-কাহিনী পাওয়া যাবে, উপনিষদও বলছে ধ্যান কিভাবে করবে, হাল্কা কোথাও কোথাও এক আধটা উপাচারের কথাও বলছে, যেমন বৃহদারণ্যক উপিনষদে পঞ্চযজ্ঞের কথা আছে। হিন্দু ধর্মের বেশীর ভাগ উপাচার তন্ত্র থেকে এসেছে, আবার পুরাণ থেকেও অনেক উপাচার এসেছে। কিন্তু সেখানেও লক্ষ্য কি, সামাজিক আচরণ বিধি কেমন হবে বলে দিচ্ছে। মনুস্মৃতিতেও আমরা দর্শনের অনেক তত্ত্ব পাই, উপাচারের কথা পাই কিন্তু মূল জোরটা দেওয়া হয়েছে মানুষের আচরণ বিধির উপর। আঠারোটি পুরাণ হল আমাদের ঠিক ঠিক পুরাণ শাস্ত্র। এর সাথে যুক্ত হয় বাল্মীকি রামায়ণ ও মহাভারত, এই দুটোকে তাই বলা হয় ইতিহাস পুরাণ।
ঋষিদের মত ছিল যে, ধর্মের এই চারটে  অঙ্গকে যদি ঠিক ঠিক অধ্যয়ন করা যায় তাহলে সনাতন হিন্দু ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ রুপে জানা যাবে। আর  জীবন-যাপনের অঙ্গ হিসাবে কেউ যদি কোন একটা মতকে অবলম্বন করে সমগ্র জীবন অতিবাহিত করে তাহাতেও সে একই ফল পাবে। হিউয়েন সাং চীনের খুব বিরাট পণ্ডিত লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে’র বিচার মার্গের সাধক। ভারতে এসে তিনি পণ্ডিতদের সাথে আলোচনা করছেন, বিচার করছেন। একবার অযোধ্যার  কাছে ডাকাতরা তাঁকে বন্দী করেছে। ডাকাতরা তাঁকে কটে ফেলবে বলে ঠিক করে নিয়েছে তখন তিনি ডাকাতদের বলছেন তোমরা আমার যা কিছু সব নিয়ে নাও, আমাকে প্রাণে মেরো না’। কিন্তু ডাকাতরা ছাড়বে না। তখন তিনি বললেন ‘আমাকে তো তোমরা মেরেই ফেলবে ঠিক করেছ। কিন্তু মরার আগে আমাকে একটু ধ্যান করতে দাও। তখন তিনি ধ্যানে বসে ভগবান বুদ্ধের মৈত্রী ভাবের উপর ধ্যান করতে লাগলেন। এটাই ভক্তিমার্গের সাধনা। ধ্যানে বসার কিছুক্ষণ পর এমন ঝড় উঠেছে যে, সবারই প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ডাকাতরা তখন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করছে লোকটি কে? যখন শুনল উনি একজন সাধু, তখন সবাই ক্ষমা চেয়ে তাঁকে ছেড়ে দিল। হিউয়েন সাং এর এই ঘটনাকে মজা করে পরে লেখা হল, যে লোকটি সারা জীবন জ্ঞানমার্গের সাধনা করে গেলেন, শুধু যুক্তি তক´ বিচার নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিলেন, কিন্তু মৃত্যু যখন শিয়রে এসে ধাক্কা মারল তখন শরণাগতি, মানে ভক্তির আশ্রয় নিলেন। মূল কথা হল জ্ঞান যেখানে নিয়ে যায়, ভক্তিও সেখানেই  নিয়ে যায়। যিনি জ্ঞানী তিনি দেখেন আত্মাই সব কিছু হয়েছেন আর ভক্ত দেখেন ঈশ্বরই সব হয়েছেন। যিনি খুব উচ্চকোটির মুসলমান তিনি দেখেন যা কিছু আছে সব আল্লাই হয়েছেন, খ্রীশ্চানরাও বলেন গডই সব কিছু হয়েছেন।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.