sanatansangbed

Introduction of SANATAN dharma scriptures

ঋগ্বেদ সংহিতা(ভূমিকা-০২)

‘বেদ’ কি- মতভেদ ও সার-সিদ্ধান্ত।

‘বেদ’ কি? – এ সম্বন্ধে কতই মতভেদ দেখা যায়। বেদ কি- এই মুদ্রিত বা পুঁথি আকারে অবস্থিত গ্রন্থ খণ্ড? অথবা, বেদ কি কয়েকটা শ্লোক বা মন্ত্র মাত্র? অথবা, বেদ কি সেই সঙ্গীতের উচ্চ স্বর- যে স্বরে বেদ মন্ত্র উচ্চারিত হয়? অথবা, বেদ কি যাগ-যজ্ঞাদি কর্ম মাত্র? কত জন কত ভাবেই বেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু বেদ কি? ধাত্বর্থের অনুসরণ করলে, জ্ঞানমূলক ‘বিদ’ ধাতু হতে ‘বেদ’ শব্দের উৎপত্তি উপলব্ধি হয়। ‘বিদ’-ধাতুর অর্থ ‘জানা’। ‘জানা’ বললেই ‘কি জানা’ ভাব আসে। জানা- ধর্ম জানা, অধর্ম জানা। জানা- সত্য জানা, অসত্য জানা। জানা- স্বরূপ জানা। ফলতঃ যার দ্বারা ধর্ম অধর্মের সত্য অসত্যের জ্ঞানলাভ হয়, অর্থাৎ যার দ্বারা স্বরূপ জানা যায়; এক কথায়, যার দ্বারা ঐহিক ও পারত্রিক সর্ববিধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়, তাহাই ‘বেদ’। সেই সর্ববিধ জ্ঞানেরই নামান্তর-পরমেশ্বরের জ্ঞান। ধাতু অর্থের অনুসরণেও (বিদ্যতে জ্ঞায়তে পরমেশ্বরোহনেন ইতি বিদ্‌ ধাতোঃ করণে ঘঞ্‌) এই অর্থই সিদ্ধ হয়। জ্ঞান সত্য, জ্ঞান নিত্য, জ্ঞান সনাতন, জ্ঞান অপৌরুষেয়; সুতরাং জ্ঞানই ধর্ম; যা জ্ঞানের বিপর্যয়, তা অধর্ম। বেদ সেজন্যই ধর্ম; বেদ-বিপর্য্যয় সে কারণেই অধর্ম। “বেদপ্রণিহিতো ধর্ম্মহ্যধর্ম্মস্তদ্বিপর্য্যয়ঃ।” বেদ যে সনাতন, বেদ যে নিত্য, বেদ যে সত্য, এই বাক্যেই তা প্রতীত হয়। এজন্যই শাস্ত্র বলছেন,- যা প্রত্যক্ষ বা অনুমান দ্বারা সিদ্ধ হয় না, বেদ তা সপ্রমাণ করে। অনুমান ও প্রমাণের অজ্ঞাত সামগ্রীর সন্ধান করে বলেই বেদের বেদত্ব।
প্রত্যক্ষেণানুমিত্য বা যস্তুপায়ো নঃবুধ্যতে।
এতং বিন্দতি বেদেন তস্মাৎ বেদস্য বেদতা ॥
যা স্বপ্রমাণ, যা স্বতঃসিদ্ধ, যার প্রমাণের আবশ্যকতা করে না, তাই ‘বেদ’। মহর্ষি আপস্তুম্বের মতে- মন্ত্র রুপ ও ব্রাহ্মণ রুপ শব্দ রাশিই ‘বেদ’ মন্ত্র জ্ঞান মূলক; ব্রাহ্মণ কর্মবিধি প্রবর্ত্তক। মন্ত্রের অর্থজ্ঞ‍ান না হলে বৈদিক কর্মে জ্ঞান হয় না; কর্মজ্ঞানের অভাবে, কর্মে প্রবৃত্তির অভাব সংঘঠিত হয়। কর্মে অপ্রবৃত্তি-নিবন্ধন, কর্মানুষ্টান হতে পারে না; কর্মের অনুষ্টানে কর্মের ফললাভ কদাচ সম্ভবপর নয়; এজন্য মন্ত্র জ্ঞানমূলক। এই বিষয়ে নিরুক্ত নামক বেদাঙ্গ গ্রন্থ রচয়িতা মহর্ষি যাস্ক বলেছেন যে- ‘মননাৎ মন্ত্রাঃ’ অর্থাৎ স্বর(উদাত্তাদি) এবং ছন্দ(অনুষ্টুভাদি) সহযোগে উচ্চার্য্যমাণ শব্দসমূহ বৈদিক কর্মে প্রবৃত্তি রুপ জ্ঞানের মনন(অর্থাৎ বোধ) করায় বলে এর নাম মন্ত্র। অর্থোপলব্ধি হলে, মন্ত্র কর্মজ্ঞান প্রবর্ত্তক হয়; কিভাবে কর্ম করলে, কত্তর্ব্য কর্মের যথোক্ত ফললাভ করে, ঐহিক সুখ ও পারত্রিক মোক্ষফল প্রাপ্ত হওয়া যায়, ব্রাহ্মণ, এইপ্রকার কর্ম বিধির বিধান করেন। জ্ঞানলাভ হেতু যে কর্ম সম্পন্ন হয়, অথবা কর্ম সম্পাদন দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয়, তাকেই ‘বেদ’ বলা হয়। এখানে কর্মে ও জ্ঞানে যেন পারস্পরিক সম্বন্ধ। ফলতঃ এতেও বুঝা যায়, যে মন্ত্রে যে প্রক্রিয়ায় পরম জ্ঞান লাভ হয়, তাই বেদ। শ্রীমৎশঙ্করাচার্য্য তাই বলে গেছেন- ‘বেদশব্দেন তু সর্ব্বত্র শব্দরাশির্ব্বিরক্ষিতঃ।’ অর্থাৎ যে শব্দরাশি প্রমাণের অপেক্ষা করে না, তাই বেদ। যা সত্য, তা প্রমাণ করার কখনও প্রয়োজন হয় না। যা সনাতন, তার পরিবর্তন কখনও সম্ভবপর নয়। তা অপৌরুষেয়, মানুষের কি সাধ্য-তার প্রবর্তনার অধিকারী হবে? সত্য যেমন আজ একরূপ এবং কাল আরেক রূপ হয় না; সত্য যেমন চিরদিনই অপরিবর্ত্তিত অব্যয় ভাবে বিরাজমান থাকে; যা প্রকৃত ‘বেদ’, যা যথার্থ জ্ঞান, তা সেইরূপ অবিকৃত, অচঞ্চল ও অবিনাশী হয়ে চিরকাল বিদ্যমান রয়েছে। জ্ঞানও যা, ব্রহ্মও তাই। শ্রুতি বলছে,- ‘বিজ্ঞানং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ।’ এজন্যই প্রাচীন ঋষিগণ বলে থাকেন,- “ন বেদা বেদমিত্যাহুর্বেদো ব্রহ্ম সনাতনম্‌।” অর্থাৎ, মন্ত্র আদি সম্বলিত পুস্তকখণ্ড মাত্র নয়; সনাতন ব্রহ্মকেই বেদ বলে। ‘বেদ’ তারই নাম- যা সত্যরূপ, জ্ঞানরূপে ও প্রমাণরূপে চির-বিদ্যমান আছে।
চলবে-
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.