ঋগ্বেদ সংহিতা ভূমিকা-০৮(বেদ-পরিচয়)
বেদ-পরিচয়।
[পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল;- বেদ অধ্যয়নে অশেষ জ্ঞান আবশ্যক; -ষড়বেদাঙ্গ;- শিক্ষা-এতে কি জ্ঞান লাভ করা যায়, তার মর্ম;- কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ;-ঐ সকলের সারমর্ম; পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি;- বেদে সাম্যভাব,-ঋগ্বেদের মন্ত্রে সাম্যভাবের বিকাশ; -বেদ বিষয়ে শাস্ত্রগ্রন্থের অভিমত- বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন মত পরিব্যক্ত;-বেদ বিভাগ,-সেবিষয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি; -ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্ব্বেদ, অথর্ব্ববেদ;-কোন্ বেদে কি কি বিষয় আলোচিত হয়েছে; বেদপরিচয়ে বিবিধ বক্তব্য।]
পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল-
ভাসা ভাসা জ্ঞান মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। বিষয়-বিশেষে গভীরভাবে মনযোগী হওয়া- সাধারণতঃ মানুষের রুচি-প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। মানুষ সকল বিষয়ই ভাসাভাসা বা উপর-উপর বুঝতে চায়। এই যে বেদ-যে বেদ নিয়ে যুগ-যুগান্ত ধরে অনন্ত-কোটি মানুষের মস্তিষ্ক বিঘূর্ণিত হয়ে গেল, সেই বেদ-বিষয়েও মানুষের সেই পল্লবগ্রাহিতা(ভাসা ভাসা জ্ঞান)-প্রবৃত্তির অসদ্ভাব নেই। বেদ কি এবং বেদে যে কি আছে, সকলেই এক কথায় তার স্থূল-মর্ম জানতে চান। বেদ কি-এক কথায় উত্তর পেলে অনুসদ্ধিৎসু চিত্ত যেন শান্তি লাভ করে। তাই উত্তরও অনেক সময় যথেচ্ছভাবে দিয়ে থাকে। যার যতটুকু অভিজ্ঞতা, তিনি সেরূপ উত্তরই দিয়ে থাকেন। বিশাল মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় করার উদ্দেশ্যে অভিগমন করে যে জন অর্ধেক পথ হতে প্রত্যাবৃত্ত হয়েছে, মহাসাগর সম্বন্ধে সে একরকম উত্তর দিবে; যে সমুদ্রতীরে পৌঁছেছিল, সে অন্য আরেক রকম উত্তর দিবে; আবার যে মধ্য-সমুদ্রে অবগাহন করেছিল, সে এসে আর এক প্রকার উত্তর দিবে। এরকম বিভিন্ন জনের নিকট বিভিন্ন প্রকার উত্তরই পাওয়া যাবে। তারপর, সে উত্তর যদি এক কথায় পাবার আকাঙ্ক্ষা কর, তাতে যে স্বরূপ-তত্ত্ব কতটুকু প্রকাশ পাবে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। এই সকল কারণেই, এক কথায় উত্তর দিতে গিয়ে, পৃথিবীর পরম-পূজ্য বেদকে কেউ বা ‘চাষার গান’ বলে ঘোষণা করে গেছেন। এতই দুর্ভাগ্য আমাদের।
বেদ অধ্যয়নে অশেষ-জ্ঞান আবশ্যক-
বেদ বিষয়টি এতই জটিল, এতই গুরুতর যে, যতই সংক্ষেপে তার বিষয় আলোচনা করা যাক, যতই এক-কথায় তাকে বুঝার প্রয়াস পাওয়া যাক; বক্তব্য বিষয় স্বতঃই বিস্তৃত হয়ে পড়ে। আমরা প্রতিপন্ন করেছি, বেদ শব্দের অর্থ-জ্ঞান। বেদ কি-এক কথায় তার সংজ্ঞা প্রকাশ করতে গেলে, জ্ঞান ভিন্ন তাকে অন্য আর কি বলতে পারি? তবে সে জ্ঞান-কি জ্ঞান, কেমন জ্ঞান, সেটাই বিশেষ অনুধাবনের অনুভাবনার বিষয়। সে জ্ঞান লাভ করতে হলে-সে জ্ঞানে জ্ঞানী হবার আকাঙ্ক্ষা করলে বড় আয়াস- বড় প্রযন্ত প্রয়োজন। সে চেষ্টা- সে প্রযন্ত মানব-সাধারণের অধিগম্য নয়। তাই বেদ আলোচনায় বেদ অধ্যয়নে অশেষ প্রতিবন্ধক কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে; -স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ বেদপাঠে অনধিকার। জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করবার অধিকার সকলের আছে; স্বয়ং বেদই সে সাম্যবাদ ঘোষণা করছেন। সেই অনুসারে স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ কারও বেদপাঠে অনধিকার নেই সত্য। কিন্তু তথাপি কেন, বেদ অধ্যয়নের পক্ষে নানা প্রতিবন্ধকতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়? কেন’ই বা অধিকারী অনধিকারীর প্রসঙ্গ নিয়ে মস্তিষ্ক আন্দোলিত হয়ে থাকে? তার কারণ যথেষ্ট আছে। পাহাড়ের উপর আরোহণ করতে হলে প্রথমে পাহাড়ের নীচের দিকে উপস্থিত হতে হয়; পরে মধ্যভাগে, পরিশেষে শীর্ষদেশে উঠবার প্রয়াস প্রয়োজন হয়। কেউই একেবারে তুঙ্গশৃঙ্গ স্পর্শ করতে সমর্থ হন না। বেদরূপ জ্ঞান লাভ করতে হলেও তেমনি স্তরে স্তরে অগ্রসর হওয়ার আবশ্যক হয়। হঠাৎ একটি সূক্ত বা ঋক্ কন্ঠস্থ করতে পারলেই এবং সেই অংশের একটা যথেচ্ছ অর্থ স্থির করতে পারলেই যে বেদ অধ্যয়ন সম্পন্ন হয়, তা নয়। বেদ অধ্যয়ন করতে হলে, সর্ব প্রথমে বেদাঙ্গে অভিজ্ঞতা-লাভ প্রয়োজন। বেদ যে অনাদি অনন্তকাল হতে অভ্রান্ত প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত হয়ে আসছে, আর যে উহা অক্ষত অপরিবর্ত্তিত ভাবে বিদ্যমান রয়েছে, বেদাঙ্গে অভিজ্ঞ হতে পারলে’ই তা বোধগম্য হতে পারে। অক্ষয় বেদাঙ্গ-সূত্র, অক্ষয় মণি-মালার ন্যায়, বৈদিক সূক্ত-সমূহকে গেঁথে রেখেছে। সুতরাং বেদাঙ্গ-তত্ত্ব আগে অনুশীলন করতে না পারলে বেদ-মধ্যে প্রবেশ করবে-সাধ্য কি?
চলবে--------------------------------------------
নিবেদনে- সনাতন সংবেদ
কোন মন্তব্য নেই